মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:৩২ অপরাহ্ন

ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির জেলা

প্রতিনিধির নাম / ৩২৩ বার
আপডেট : শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০২৩

ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাংলাদেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী তিতাস-বিধাউত জেলা, একটি নদীমাতৃক সমতল শহর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল, জেলাটি পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ জেলা, উত্তরে সিলেটের হবিগঞ্জ জেলা এবং দক্ষিণে ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা জেলা দ্বারা বেষ্টিত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয় কারণ এই জেলাটি সুরস্মৃত আলাউদ্দিন খানসহ বিভিন্ন সঙ্গীত শিল্পীর জন্মস্থান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। অনেকের ধারণা সেন বংশের শাসনামলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিজাত ব্রাহ্মণ বংশের অভাবের কারণে পূজা-অর্চনায় বিঘ্ন ঘটে, যার কারণে রাজা লক্ষ্মণ সেন আদিসুরের কন্যাকুঞ্জ থেকে কিছু ব্রাহ্মণ পরিবারকে এই অঞ্চলে নিয়ে আসেন।

এর মধ্যে নগরীর মৌলভী পাড়ায় কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার বাড়ি তৈরি করে। ওই ব্রাহ্মণদের বাড়ির অবস্থানের কারণেই জেলার নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেকেই এই যুক্তি বিশ্বাস করেন না।

অন্য একটি তত্ত্ব অনুসারে, দিল্লির একজন ইসলাম প্রচারক শাহ সুফি হযরত কাজী মাহমুদ শাহ উক্ত ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোকে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় লোকজন ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ‘বাউনবাইরা’ বলে ডাকে। আবার এই জেলার একটি বিকৃত নাম রয়েছে ‘বি-বাড়িয়া’ অনেকেই এই নামে ডাকেন। এর ফলে জেলার ঐতিহ্য লোপ পেয়েছে বলে মনে করছেন ইতিহাসবিদরা, যার ফলশ্রুতিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 2011 সালে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে যে কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিবর্তে ‘বি-বাড়িয়া’ লিখতে পারবে না বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
1860 সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মহকুমা স্থাপিত হয়। এই জেলাটি প্রাথমিকভাবে বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারত বিভাগের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা জেলার একটি মহকুমা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এরপর ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

আবার ১৮৩০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বর্তমান সরাইল উপজেলা ছিল ময়মনসিংহ জেলার একটি পরগণা। আর সে সময় আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইল পরগনার অন্তর্গত ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, পাঠান সুলতান শেরশাহ তার রাজস্ব সংগ্রহ ও প্রশাসনের জন্য প্রথম পরগণা তৈরি করেছিলেন। তাই বলা যায়, সুলতানি আমলে সরাইল পরগণার সৃষ্টি হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলাকে সে সময় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, কারণ এই অঞ্চলটি বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে খ্যাতি অর্জন করেছিল। তিনি সরাইল উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন, বাংলার বার ভূঁইয়া শ্রেষ্ঠ ভূইয়া মসনদে আলা নামে পরিচিত ঈসা খাঁ। তিনি সরাইলে বাংলায় প্রথম ও অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেন।

ঈসা খানের বংশতালিকা থেকে জানা যায় যে, ভারতের বৈশ্বরা রাজ্যের রাজপুত্রদের একজন কালিদাস গাজদানী সৈয়দ ইব্রাহিম মালেকুল উলামার কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সুলায়মান খান নাম ধারণ করেন। এরপর ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুলায়মান খান বাংলায় আসেন। সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের পর তিনিই প্রথম সরাইল পরগণার নেতৃত্ব দেন। অতঃপর সুলায়মান খানের প্রতিপক্ষ পাঠান বাহিনী তাকে ডেকে এনে মিথ্যা সন্ধি প্রস্তাব দিয়ে হত্যা করে।

এ সময় ঈসা খানের বয়স মাত্র দশ বছর। পরবর্তীতে ঈসা খান ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে একটি বড় শক্তিতে পরিণত হন। এই অঞ্চলের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তিনি মুঘল বাহিনীর সাথে যে যুদ্ধ করেছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। তৎকালীন ঈসা খানের নেতৃত্ব এবং তার যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব তাকে এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়। তিনি সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুঘল সেনাপতি মান সিং তার জীবনে কখনোই ঈসা খানকে পরাজিত করতে পারেননি।

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশিরভাগ অংশ ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। 1830 সালে সরাইল, দাউদপুর, হরিপুর, বেজুরা এবং সাতরাকান্দল পরগণা ময়মনসিংহ থেকে ত্রিপুরা জেলায় স্থানান্তরিত হয়। 1860 সালে নাসিরনগর মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এলাকা এর অধীনে আসে। 1875 সালে নাসিরনগর মহকুমার নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার নামকরণ করা হয়। এর আগে ১৮৬৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরকে পৌরসভায় উন্নীত করা হয়।

1947 সালের পর বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে আসে। 1960 সালে, ত্রিপুরা জেলার পূর্ব পাকিস্তান অংশের নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা জেলা করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন মহকুমা শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা-উত্তর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সময় 1984 সালের 15 ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলা ঘোষণা করা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা একদিকে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে এ জেলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। নৃপেন্দ্র দত্ত রায় উল্লাস কর দত্ত, অতীন্দ্রমোহন রায় অখিল চন্দ্র নন্দী, এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের আরও অনেক বিপ্লবীর জন্ম

Facebook Comments Box


এ জাতীয় আরো সংবাদ

Archives